সিরাত: কেমন ছিলেন রাসূল (সাঃ)?

জগতে খুব কম মানুষেরই জীবনই ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু কোন মানুষ কি আছে ত্রুটিহীন? এমন একজন মানুষের কথা উঠলে সবার আগে আসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর কথা। যার জীবনের প্রতিটি অংশই শিক্ষণীয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যা আলোচনা করা সম্ভব। মহানবী মুহাম্মদ স. এর জীবনী প্রাথমিকভাবে কয়েকটি অংশে বিভক্ত। যেমনঃ
• ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ
• পারিবারিক জীবনে আদর্শ
• সামাজিক জীবনে আদর্শ
• শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে আদর্শ
• অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনে আদর্শ
• রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থায় আদর্শ
• আন্তর্জাতিক কুটনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদর্শ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশের উপরে আলোকপাত করা হলো।

এক.
মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর ব্যক্তি জীবন ছিলো তার মতোই স্বচ্ছ, নির্মল ও সাধারণ। তিনি শৈশব থেকেই অত্যন্ত সত্যবাদী ও সতর্ক মানুষ ছিলেন। যাবতীয় মানবিক মৌলিক গুণাবলী নিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন। জাহেলি যুগের অসভ্য আরব জাতি তাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধি দিতে বাধ্য হয়। প্রতিপক্ষের আমানতও থাকতো তাঁর সর্বোচ্চ হেফাজতে। তিনি কথা দিলে তা যেকোনোভাবে পূর্ণ করতেন। বন্ধু, সহপাঠী ও সহকারীদের মধ্যে তিনি পূর্ণ ভ্রাতৃত্ব বাস্তবায়ন করে দেখান। অল্প বয়সেই মানবতার কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিলফুল ফুজুল’ – নামক সংস্থা। জন্মের পূর্বে বাবা হারানোর পর ৬ বছর বয়সে মাকেও হারান তিনি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানসিক ভারসাম্য ও ধৈর্যের চর্চার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. ।

দুই.
পরিবার একটি সভ্যতার প্রধান ক্ষুদ্র সংগঠন। পরিবার বিবেচনায় সভ্যতার অগ্রগতি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. বর্বর যুগে শিখিয়ে গেছেন আদর্শ পরিবার গঠন। পারিবারিক মিল-বন্ধন, সৌহার্দ্য পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিখিয়েছেন নিজে চর্চার মাধ্যমে। তিনি যেভাবে তাঁর স্ত্রীদের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন তা সেই যুগে কল্পনাতীত। পাশ্চাত্যের আধুনিক পরিবার কাঠামোকেও যা হার মানায়। কখনো কখনো তিনি তাঁর স্ত্রীকে গৃহ পরিচালনায় সহায়তা করেছেন, কখনো তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে চাঁদনী রাতে দৌড়পাল্লাও দিয়েছেন। শিখিয়েছেন নমনীয়তা, শিখিয়েছেন আদর্শ স্বামীর গুণাবলী।

তিন.
সে সময় ছিলো গোত্র বনাম গোত্রের যুদ্ধ। সামান্য কিছুতেই রক্তপাত, বেহুদা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভিন্ন গোত্র কিংবা বংশের মানুষ সমাজের অংশ হতে পারতো না। সামাজিক নৈতিকতা বলে কিছু ছিলো না। ছিলোনা কোনো শৃঙ্খলা। সন্তান পিতাকে শ্রদ্ধা করতো না, পিতা সন্তানের সাথে নির্মম আচরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। অবাধ মাদক গ্রহণ ও যৌনাচার ছিলো স্বাভাবিক সামাজিকতা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে একে একে নির্মান করেন আধুনিক সভ্যতার রূপরেখা। ভিন্ন ভিন্ন গোত্র ও মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন সমাজ ব্যবস্থা। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলেন সবার মধ্যে।

চার.
মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. স্বয়ং স্রষ্টা থেকে শিখে, শিখিয়েছেন মানবসভ্যতাকে। ‘পড়’ শব্দ দিয়ে নবুয়ত জীবনের যাত্রা শুরু করেন। তিনি তাঁর সহচর প্রত্যেকের বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষণ তাঁদের শিখিয়ে গেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থাগুলো। চুল, দাড়ি থেকে পায়ের নখ– গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন একজন মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এমন সব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতিকে অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করেছে। গণঅধিকার থাকায় যা কারো জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত ক্ষেত্র নয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. বদর যুদ্ধের বন্দিদের শিক্ষার বিনিময় মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রীয়ভাবে লেখার কাজে ৫০ জন লেখক নিয়োজিত ছিল। তিনি হিজরতের পর মসজিদে নববী কেন্দ্রীক “সুফ্ফা” প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পৃথিবীর ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছেন।

পাঁচ.
একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপরে সে দেশের গোটা ব্যবস্থাটাই নির্ভর করে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর মিশন পূর্বে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন ছিলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নিয়ম। কারো কাছে কেউ নিরাপদ ছিলো না। লুণ্ঠন, রাহাজানি, ডাকাতি, জুয়া, প্রতারণা ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সুদের উপরে নির্ভরশীল আরবের ছিলো গোটা অর্থব্যবস্থা। শোষিত শ্রেনীর প্রতি শোষণ ছিলো সীমাহীন, গোলামের‌ শ্রম ছিলো সমাজের চাবিকাঠি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এসকল ব্যবস্থা ভেঙে পুনরায় নির্মান করেন। স্বাভাবিক বাণিজ্যের প্রচলন ঘটান। বিত্তবানদের থেকে নেওয়া যাকাতের কর দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ শুরু করেন। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে তাঁর গৃহীত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপগুলো চূড়ান্তরূপে সফল হয়।

ছয়.
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সুশৃঙ্খলভাবে তা পরিচালনা করা ছিলো সব থেকে চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তৎকালীন যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে প্রায় শাসনক্ষমতা পরিবর্তন হতো কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সহজে কেউ রাষ্ট্র পরিচালনা করে যেতে পারতো না। স্থায়ী সরকারের অনিশ্চিতয়তার মানুষের রাজনৈতিক জীবনও অনিশ্চিত থেকে যেত। সমাজে ছিলো না কোনো সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা। কলহ-বিবাদে ছড়াছড়ি ছিলো চারদিক। অনৈতিকতা ছিলো একেবারে সাধারণ বিষয়। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পরিবার সবখানেই ছিলো চরম অরাজকতা। এক সেক্টর মেরামত করতে গেলে অন্য সেক্টর গায়েব হয়ে যেত। এত বিশৃঙ্খলার সত্ত্বেও মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে একের পর এক সফল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করেন। আন্তর্জাতিক সংহতি অর্জনও ছিলো তাঁর অন্যতম সফলতা।

সুতরাং বলা যায়– জ্ঞানে, গুণে, চরিত্রে, দক্ষতায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. ছিলেন অনন্য। যিনি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে সক্ষম হন। যার আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে দেশান্তরে। এখনো প্রায় প্রত্যেক দেশেরই কিছু না কিছু মানুষ শ্রদ্ধার সাথে ধারণ করছে তাঁর আদর্শ।

জগৎ এর এই শ্রেষ্ঠ মানুষ সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য জানতে হলে আমাদের সিরাত পড়তে হবে। অনেকেই ভালো বই পাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। আপনি যদি তেমনি একজন হয়ে থাকেন, তাহলে ভালো মানের ইসলামিক বইগুলো সহজেই পেতে যোগাযোগ করুন দারসুল হিকমাহ বুকস্টোরে। যেখানে পাবেন ইসলামিক ইতিহাস, সিরাহ, দাওয়াহ, কর্মপন্থা, উসুল, ইলম, আমল, আত্মশুদ্ধি সহ নানান ক্যাটাগরির ইসলামিক বই।

Main Menu